09 July 2020

পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার সেকাল একাল




আমরা যারা এনজিওর কর্মী বা যারা সমাজকে আরো প্রগতিশীলতার পথে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা তৈরির কাজে নিয়োজিত, সচরাচর আমরা সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা পুরুষতন্ত্র নামক কালনাগের আক্রমন নিয়ে খুবই বিচলিত থাকি। আমাদের সবার প্রচেষ্টা পুরুষ ও মহিলার সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা। (Goal 5 of Sustainable Development Goal talks about Gender Equality)। বর্তমানযুগেও পুরুষ ও মহিলার সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা এত কঠিন কেন?

এবার আসি আলোর কথায়। আজ থেকে প্রায় বছর ষাট আগের কথা। আলো তার বাবা, মা, তিন দাদা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে একটা ছোট গ্রামে থাকে। আলোর মা খুব উদার মনের মানুষ। আসে পাশের কয়েকজন অসহায় বৃদ্ধ বৃদ্ধার রোজকার খাবারের দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন। যদিও আলোরা খুব অবস্থাপন্ন ছিলনা, তবে আলোর বাবা এ ব্যপারে তার মাকে বাধা দেননি। আলো তার বান্ধবীদের সাথে ও খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোনদের সাথে বেশ মজা করেই দিন কাটাতে থাকে। বুদ্ধিমতি, হাসিখুশী ও মিশুকে স্বভাবের জন্য আলোকে তার গ্রামের সবাই খুবই ভালোবাসত। আলো যখন ক্লাস সিক্সে উঠল, তার বাবা তাকে শাড়ি পড়ার কথা বলল, কারণ একমাত্র শাড়িতেই মেয়েদের শোভন দেখায়। আলোর খুব ইচ্ছা করত একটা গোলাপী রঙের ফ্রক পড়ে দাদাদের মত সাইকেল চালিয়ে স্কুল যাবে। কিন্তু সে যে বাবার আদেশ পালনকারী ভালো মেয়ে, তাই সে নিজের সব ইচ্ছেগুলোকে তিলে তিলে মেরে ফেলল। তার দাদারা ও ভায়েরা কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেল, কেউবা নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ, বিএড পড়তে গেল। আর সে গ্রামের সবথেকে কাছের কলেজে পাশ কোর্সে বিএতে ভর্তি হল। আর তার কন্যাদায়গ্রস্হ বাবা তাকে পাত্রস্হ করার প্রস্তুতিপর্ব শুরু করলেন। বিয়ের এক বছর পর আলোর এক ছেলে ও তার বছর চার পর এক মেয়ে হল। মাঝখানে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। আলো সুখে সংসার করছে।

এখন আসাযাক আলোর মেয়ে দ্যুতির কথায়। দ্যুতি যেন আলোরই প্রতিচ্ছবি। বুদ্ধিমতি, হাসিখুশি, মিশুকে। তবে দ্যুতি ভীষণ জেদি। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার এক অদম্য জেদ ওর মধ্যে। দ্যুতি বর্তমান প্রজন্মের চিন্তাবাহক। দাদার সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে চলতে চায় সে। আলো তাকে ভালো মেয়ে তৈরীর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে ও প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। ধীরে ধীরে মা ও মেয়ের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। আলোর বাবার শেখানো চিন্তাধারাকে দ্যুতি বুড়ো আঙুল দেখায়। বড়োরা যা বলেন তা ভালোর জন্যই বলেন, ছোট থেকে এই আদর্শ শেখানো সত্বেও দ্যুতি যে এমন কেন হল তা আলো বুঝতে পারেনা।

আলোর কাছে তার বাবার আদর্শই একমাত্র সত্য আর দ্যুতি চায় সমানতা। দ্যুতি বুঝতে পারেনা মায়ের কথা রাখবে না কি নিজে যে মতাদর্শে বিশ্বাসী সেই পথেই চলবে, কিন্তু তাহলে যে মাকে কষ্ট দেওয়া হবে।

পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার অবসান ঘটাতে চাইলে কি শুধু পুরুষদের সমানতার টিকা দিলেই চলবে নাকি যে মহিলার চিন্তাভাবনা পুরুষতন্ত্র কলুশিত করে দিয়েছে বহু বছর আগে, তারও কিছুটা সতেজ দমকা হাওয়ার প্রয়োজন নতুন চিন্তাভাবনাকে আপন করে নেওয়ার জন্য - এই জটিল বিষয়ই বোধহয় পুরুষ ও মহিলার সমান অধিকারের পথে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাড়িয়ে আছে।

No comments: