23 February 2022

এক লক্ষ্মী মেয়ের উপাখ্যান

 রিমঝিমকে নিয়ে আজ একটা গল্প বলা যাক। রিমঝিমের বাড়ি কালনা। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে রিমঝিম। বড় আদরের ধন। বাড়ির বড়রা তার পোশাক, চুলের দৈর্ঘ্য, কথা বলার বাচনভঙ্গি, হাসির ধরন, হাঁটার গতি সব কিছুই স্কেল দিয়ে মেপে দিয়েছিল। ছোট থেকেই সে কড়া অনুশাসন মেনে এসেছে। আর পাঁচটা ভালো মেয়ের মতো সেও বাড়ির গুরুজনদের কথা শুনতেই অভ্যস্ত। বাবা, মা, ঠাম্মা, কাকাই, পিসিমনি সবার বাধ্য মেয়ে হয়েছে সবসময়। তাই সে তকমাও পেয়েছে সেরা সেরা, একদম সুন্দর করে বাঁধিয়ে আলমারিতে টাঙ্গিয়ে রাখার মতো। বড়দের আদেশ ছাড়া কোনদিনো কোন কাজ করেনি সে। 

পড়াশোনা আর রান্না - এই দুটো জিনিষ ছাড়া বাড়িতে একটা ছোট বাগান করারও অনুমতি পেয়েছিলো সে। নিজের বাগানে পিসিমনির সাথে জবা, বেলি, রজনীগন্ধা, নয়নতারা আরও কত্ত কি গাছ লাগিয়েছিল। নিজের বাগানখানা নিয়ে খুব গর্বও ছিল তার । বাড়িতে কেউ এলে বাগানখানা  দেখাবার জন্য অপেক্ষা করে থাকত সে। এইভাবে আস্তে আস্তে রিমঝিম স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হল। বাড়ির সবাই বললো পাস কোর্সে পড়তে। কিন্তু তার খুব সখের জন্য সে হোম সায়েন্সে অনার্স নিয়েছিল। বাড়ির লোকজন খুব একটা আপত্তি করেনি অবশ্য। মেয়ে কলেজে ভর্তি হবার পর মা জোর করল এবার মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে। মেয়েকে নিজের বাড়িতে পাঠাতে হবে। শুরু হল তার জন্য পাত্র দেখা।  

খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী রিমঝিমের বর্ণনা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাওয়াতে প্রথম দেখাশোনাতেই পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে গেল তাকে। পাত্র ট্রাকের ব্যাবসা করে। পাত্রের  পড়াশোনাটা একটু কম বটে, কিন্তু প্রচুর পয়সা আর অগাধ সম্পত্তি। ফাল্গুনের এক শুভ দিন দেখে রিমঝিমের বিয়ে হয়ে গেল। রিমঝিম শ্বশুর বাড়ি গেল। অষ্টমঙ্গলাতে কালনার বাড়িতে আসার পর বুঝল এটা তার বাপের বাড়ি হয়ে গেছে, নিজের বাড়ি আর নেই।     

শাশুড়ি তার নিজের মতো করে রিমঝিমকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন। তার বাপের বাড়ির মতো শ্বশুর বাড়িরও সবাই চাইল যে রিমঝিম তাদের সব কথা শুনে চলবে। রিমঝিম সবার মন জুগিয়ে চলতে লাগল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তার কোল আলো করে এলো এক ফুটফুটে ছেলে, তার বছর চারেক পর এলো এক মেয়ে। এরকম ভাবেই দশটা বছর কোন দিক দিয়ে কেটে গেল রিমঝিম তা বুঝতেই পারলনা। আস্তে আস্তে সে কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল। কোন কিছুই যেন তাকে আর আনন্দ দেয় না। যত দিন যেতে থাকল রিমঝিম তত যেন মনের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব করতে থাকল। সব থেকেও যেন কি একটা নেই।   

রিমঝিমের শ্বশুরবাড়ির পাশের বাড়িতে ভাড়াতে  থাকতে এলো ঝর্ণা। ঝর্ণা বয়েসে তার থেকে বছর তিন-চারেকের ছোটই হবে। চাকরি করে, বিয়ে করেনি। নিজের ইচ্ছেমতো জামা কাপড় পরে। নিজের ইচ্ছেমতো সাজগোজ করে। পার্লারে গিয়ে কায়দা করে চুল কাটে। গড়গড় করে ইংরেজি বলে, গান করে, নাচ করে। কারোর আদেশের অপেক্ষা করেনা। স্বাধীন ভাবে ঘুরে বেড়ায় বন্ধুবান্ধবীদের সাথে। দেখে যেন মনে হয় জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে নিঙড়ে উপভোগ করে। রিমঝিমেরও ইচ্ছা হয় ঝর্ণার মত করে বাঁচতে। সহজ, সরল আর স্বচ্ছ জীবনযাপন করতে।    

"তুমি মেয়েমানুষ, তুমিতো মায়ের জাত, তোমার প্রচুর সহ্যশক্তি হতে হবে, সংসার করতে হবে আর তোমাকে লক্ষ্মী মেয়ে হতে হবে" - ছোট থেকেই রিমঝিম এসব শুনেই বড় হয়েছে। রিমঝিমের কাছে একজন মেয়ের সংজ্ঞা এতদিন যা ছিল ঝর্ণা তার পুরো উল্টো। সে তো কালি ঠাকুরের অবতার যেন। সবকিছু মুখ বুজে মেয়ে নেয়না, যুক্তি দিয়ে বোঝে আর তারপর মেনে নেওয়ার হলে মানে নইলে তার প্রতিবাদ করে। মেয়েমানুষ আবার গলা উঁচু করে কথা বলে নাকি? তাও আবার পুরুষের বিপরীতে। রিমঝিম যতই ঝর্ণাকে দেখতে থাকল ততই অবাক হয়ে যেতে থাকল। তার ইচ্ছে হল নিজের মেয়েটাকে পুরো ঝর্ণার মত করে বড় করবে। তার মেয়েও ঝর্ণার মত নিজের জীবনটা পুরোপুরি উপভোগ করবে। কারুর হাতের পুতুল হবেনা, কারুর থেকে ভালো মেয়ের তকমা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেনা।  

রিমঝিম ঝর্ণাকে একদিন অনুরোধ করল তার মেয়ে রুমিকে একটু গান আর নাচ শেখাবার জন্য। ঝর্ণাও রাজি হয়ে গেল। রুমির নাচ আর গানের হাতেখড়ি শুরু হল। ঝর্ণার ভাড়া বাড়িতেই সে শিখতে যেত। এইভাবে নানা আছিলায় রিমঝিমেরও ঝর্ণার ভাড়া বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হল। রিমঝিম আর ঝর্ণা দুই বিপরীত মেরুর মানুষ। কিন্তু ঝর্ণা কেমন সুন্দর করে রিমঝিমের জগতের গল্প করতে শুরু করল তার সাথে। আস্তে আস্তে রিমঝিম নিজের অজান্তেই  ঝর্ণার সাথে নিজের তুলনা করতে শুরু করল। রিমঝিম ভাবতে শুরু করল আমি সারা জীবন বাপের বাড়ি - শ্বশুরবাড়ি সবার কথা শুনে এসেছি, আমি ভালো আর ঝর্ণা কারুর কথা শোনেনা, নিজের মতে সব কিছু করে তাই আমি ভালো আর ঝর্ণা বাজে। এইভাবে ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে রিমঝিমের গোটা মনটা ঝর্ণার প্রতি কেমন যেন বিষিয়ে যেতে থাকল।    

লক্ষ্মী মেয়েরই তো ভালো থাকার কথা, আনন্দে থাকার কথা, তবে রনচণ্ডী কেন নিজের জীবন বেশি উপভোগ করবে? এত অন্যায় রিমঝিমের আর সহ্য হচ্ছিলনা। হিংসে? না, তা কি করে সম্ভব? রিমঝিমের তো ঘর, বর, বাচ্ছা, সংসার সব আছে। ঝর্ণার তো কিছুই নেই। তবে মনের মধ্যে এমন কেন হচ্ছে? মনের মধ্যে অশান্তি নিজেই কাটতে থাকল রিমঝিমের দিন। ঝর্ণার সাথে খুব খারাপ ব্যাবহারও শুরু করে দিল সে। পাড়াতে যাকে পেল তার কাছেই ঝর্ণার নিন্দে করতে শুরু করল রিমঝিম। রিমঝিমের আচরণে দুঃখ পেয়ে ঝর্ণা রুমিকে জানাল যে তার খুব শরীরখারাপ, তাই এখন আর সে গান আর নাচ শেখাতে পারবেনা। রিমঝিমের আরও রাগ হল। সে যেন ঝর্ণাকে শেষ করে দিতে চাইল..........."মেয়েরাই মেয়েদের প্রধান শত্রু" কে যেন পাশ থেকে বলে উঠল। 

এমন কেন হল? রিমঝিম ভালো মেয়ে। রিমঝিমতো ভালো মেয়ে হতেই চেয়েছে বরাবর। সে কিকরে ঝর্ণাকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করল? আবার যেন পাশ থেকে কে বলে উঠল - ভালো মেয়ে হতে গিয়ে রিমঝিম প্রতিদিন নিজের ইচ্ছাগুলোকে দমন করে এসেছে। আর এইভাবে আস্তে আস্তে তার অজান্তেই তার অবচেতন মন তার বিরুদ্ধে চলে গেছে। ভালো খারাপের মাপকাঠি এতো কঠোর হয়ে উঠেছে যে রিমঝিম আর সুখে নেই, রিমঝিমরা আর সুখে নেই। শান্তি নেই, শুধু আছে কুঠারের আঘাত। লক্ষ্মী মেয়েদের মনের আয়ানা ভাঙ্গলে তা যেন সবকিছু তছনছ করে দেয়। তুমি নাহয়  একটু লক্ষ্মী, একটু কালি, একটু চণ্ডী, একটু সরস্বতী আর অনেকখানি দুর্গা হলে। তখন দেখবে সবাইকে কেমন সুন্দর নিজের করে নিতে পারছো। নিজেকে ভালো প্রমান করার জন্য তোমাকে আর কাউকে ছোট করার প্রয়োজন হবেনা। বন্ধুতের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে সবার জন্য। নিজেকে নিজের সবটা নিয়ে গ্রহন করে দেখ, পৃথিবীটা সুন্দর নিজেই হয়ে যাবে। 

No comments: